নিউমোথোরাক্স (Pneumothorax)শ্বাসতন্ত্রের রোগ 

নিউমোথোরাক্স (Pneumothorax)- উপসর্গ, কারণ, প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, ঔষধ

নিউমোথোরাক্স কাকে বলে?

ফুসফুস আবরক ঝিল্লীর মধ্যে বায়ু সঞ্চয় হলে তাকে নিউমোথোরাক্স (Pneumothorax) বলে। ফুসফুসে প্লুরা নামক বাইরের এবং ভিতরের একটি করে আবরণ আছে। এই দুই আবরণের মাঝের অঞ্চলকে প্লুরাল ক্যাভিটি (গহ্বর) বলে, যার মধ্যে বায়ু বা তরল জমা হতে পারে। তবে সচরাচর এটি চুপসে থাকে এবং এর মধ্যে সামান্য পরিমাণ প্লুরাল তরল থাকে।

যখন দুই প্লুরা আবরণীর মাঝের এই অংশে বায়ু প্রবেশ করে তখন নিউমোথোরাক্স ঘটে। অর্থাত ফুসফুস ও চেস্ট ওয়ালের (chest wall) মধ্যবর্তী স্থানে বায়ু প্রবেশ করলে নিউমোথোরাক্স হয়ে থাকে। এই বায়ু ফুসফুসের বাইরে চাপ প্রয়োগ করে ফুসফুসকে চুপসে দেয়। ফলস্বরূপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর ফলে ফুসফুসের একটি অংশ চুপসে থাকে।

অন্তর্নিহিত ফুসফুসের রোগের কারণে সেকেন্ডারি (গৌণ) নিউমোথোরাক্স সৃষ্টি হয়। অবশ্য প্রাইমারি নিউমোথোরাক্স ঘটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোন রোগের উপস্থিতি ছাড়াই।

কিছুক্ষেত্রে, বায়ু জমে থাকার ফলে হৃদযন্ত্র ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গ, যেমন- খাদ্যনালী, তাদের নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে সরে যেতে পারে। এর ফলে রক্ত সংবহনে ব্যাঘাত ঘটে থাকে।

ফুসফুসে অস্ত্রোপচার, বুকে আঘাত লাগা বা ফুসফুসের কোনো রোগের কারণে নিউমোথোরাক্স হতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াও রোগটি হয়ে থাকে। সাধারণত: এর লক্ষণ স্বরূপ হঠাৎ বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।

বেমিরভাগ ক্ষেত্রে নিউমোথোরাক্স ছোট হলে এবং জটিল রূপ ধারণ না করলে, এটি এমনিতেই সেরে যায়। আর নিউমোথোরাক্স বড় আকার ধারণ করলে, চিকিৎসকেরা সাধারণত পাঁজরের ভিতর দিয়ে নমনীয় টিউব বা সূচ প্রবেশ করিয়ে এর অতিরিক্ত বাতাস বের করে থাকেন।

নিউমোথোরাক্স এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গ

নিউমোথোরাক্স এর ভিন্নতা অনুসারে এর বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়। অবশ্য যদি এটি টেনশন নিউমোথোরাক্স না হয়, তাহলে রোগি সামান্য অস্বস্তিবোধ করতে পারে আবার নাও বুঝতে পারে যে নিউমোথোরাক্স ঘটেছে। নিউমোথোরাক্স এর সবচেয়ে পরিচিত উপসর্গ হল হাঁপ লাগা এবং বুকে ব্যথা। সহজে বোঝা যায়না বলে সমস্যা সৃষ্টির পর নিউমোথোরাক্স এর চিকিৎসা করাতে রোগীর বেশ কিছুদিন সময় লেগে যেতে পারে। এর অন্যতম লক্ষণগুলি হল নিম্ন রক্তচাপ, কম অক্সিজেন মাত্রা এবং শ্বাসক্রিয়ার হার বৃদ্ধি।

টেনশন নিউমোথোরাক্স তুলনামূলক আরো প্রকট। গুরুতর আঘাত, ভেন্টিলেশন (কৃত্রিম শ্বাস প্রক্রিয়া), রিসাসিটেশন (জীবনীশক্তির পুনরুদ্ধার) প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই প্রকার নিউমোথোরাক্স ঘটে থাকে। হাঁপ ধরার ফলে রোগীর অক্সিজেন মাত্রা কমে যায়। এতে প্রাথমিকভাবে ট্যাকিপনিয়া (দ্রুত অগভীর শ্বাস) ও ট্যাকিকার্ডিয়া (হৃদযন্ত্রের উচ্চ গতিবেগ) এবং পরবর্তীতে হাইপোক্সিয়া (অক্সিজেনের অভাব), হাইপোভেন্টিলেশন (শ্বাসের হার কমে যাওয়া) ও সায়ানোসিস (নীল হয়ে যাওয়া) উপসর্গ দেখতে পাওয়া যায়।  

নিউমোথোরাক্স এর প্রধান কারণ

ফুসফুস দুটির উপর দুটি আবরণ থাকে, এদর প্লুরা বলে। প্লুরার দুটি স্তর- বাইরেরটিকে বলে প্লুরা এবং ভিতরের স্তরকে বলে ভিসারেল প্লুরা। এই দুই স্তরের মধ্যে নানা কারণে Infection থেকেই এর মধ্যে বায়ু জমে। ফুসফুসের এরিওলারের মধ্যে বায়ু প্রবেশ করে ফুসফুসের বায়ুকোষ বর্ধিত হলে ফুসফুসের বায়ু স্ফীত বা এম্ফাইসিমা বলে কিন্তু প্লুরার থলির মধ্যে গ্যাস বা বায়ু সঞ্চয় হলে একে নিউমোথোরাক্কা বলে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, প্লুরার মধ্যে শুধু বায়ু থাকে না, এর মধ্যে যে বায়ু সঞ্চিত থাকে তার সঙ্গে মিশ্রিত থাকে পুঁজরক্ত বা সেরাম। যদি বায়ুর মধ্যে শুধু রক্ত ভাসে তবে তাকে হেকাটো থোরাক্স বলে।

ব্লেব (ফুসফুসের উপরে ছোট ছোট বাতাস পূর্ণ ফোস্কা) নামক একটি বুদবুদ ফেটে যাওয়ার ফলে বা আঘাতের কারণে প্লুরাল গহ্বরে বায়ু প্রবেশ করতে পারে। ফলস্বরূপ ফুসফুস ভিতরের দিকে চুপসে যায়, যা শ্বাস প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। টিস্যুর আঘাত যখন প্লুরাল গহ্বরে বায়ু ঢুকতে দেয় কিন্তু বের হতে বাধা দেয় তখন টেনশন নিউমোথোরাক্স সৃষ্টি হয়। ফলে প্রতি প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুস ক্রমশ আরো চুপসে যেতে থাকে।

লম্বা পাতলা গড়ন, ধূমপান, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, অ্যাজমা, সিওপিডি (ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ) প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিউমোথোরাক্স ঘটার সম্ভাবনা বেশি হয়।

  • বুকে আঘাত: বুকে তীক্ষ্ণ বা ভোতা যে কোনো আঘাতের ফলে ফুসফুস অকেজো হয়ে যেতে পারে। এছাড়া শারীরিক আক্রমণ বা সড়ক দুর্ঘটনার কারণেও নিউমোথোরাক্স হতে পারে। আবার বুকে সূচ ঢোকানো প্রয়োজন এমন যে কোন অপারেশন করার সময়ও দুর্ঘটনাবশত নিউমোথোর‌াক্স হতে পারে।

 

কিভাবে নিউমোথোরাক্স নির্ণয় করা হয় এবং এর চিকিৎসা কি?

নিউমোথোরাক্স নির্ণয় নিশ্চিত করা হয় বিভিন্ন পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান বা এক্স-রে’র মাধ্যমে। নিউমোথোরাক্স এর আয়তন ও প্রকৃতির উপর নির্ভর করে এর চিকিৎসা নির্ভর করে। ছোট নিউমোথোরাক্স এর ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা প্রদান করে দ্রুত রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে এবং পরবর্তী চেকআপের প্রয়োজন হতে পারে।

আরো গুরুতর ক্ষেত্রে, অথবা টেনশন নিউমোথোরাক্স হলে, সময় নস্ট না করে ইনজেকশনের সূঁচ প্রবেশ করে বুকে জমে থাকা বাতাস বের করে দেওয়া দরকার। নিউমোথোরাক্স পুনরাবির্ভাবের বিশেষ সম্ভাবনা থাকে; একারণে এর যথাযথ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।

ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়

নিম্নলিখিত বিষয়গুলি রোগটির ঝুঁকি বৃদ্ধি করে-

  • লিঙ্গ: সাধারণত মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
  • ধূমপান: ধূমপান কতোদিন ধরে করা হচ্ছে এবং কী পরিমাণে করা হচ্ছে তার উপর এই রোগটি হওয়ার ঝুঁকি নির্ভরশীল [এমফাইসিমা (emphysema) ছাড়াও]।
  • বয়স: সাধারণত ২০-৪০ বছর বয়সের ব্যক্তিদের ফুসফুসের বাতাসপূর্ণ ফোস্কা ফেটে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট নিউমোথোর‌াক্স বেশি হয়ে থাকে। এক বয়সের কোনো ব্যক্তির উচ্চতা যদি খুব বেশি এবং ওজন যদি স্বাভাবিকের তুলন কম হয়, তাহলে তার এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পায়।
  • জেনেটিক্স: কিছু কিছু পরিবারে কয়েক ধরনের নিউমোথোরাক্স বেশি হতে দেখা যায়।
  • আগে নিউমোথোরাক্স হওয়া: কোনো ব্যক্তির কখনও নিউমোথোরাক্স হলে ১-২ বছরের মধ্যে তার পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশিথাকে।

Related posts

Leave a Comment