পেরিকার্ডাইটিস Pericarditis ঃ কারণ, লক্ষন ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
পেরিকার্ডাইটিস কি?
হৃদযন্ত্রের বাইরে ও ভিতরে উভয় দিকেই আবরণ থাকে। বাইরের আবরণকে পেরিকার্ডিয়াম (pericardium) এবং ভিতরের আবরণকে এন্ড্রোকার্ডিয়াম বলে। পেরিকার্ডিয়াম হার্টের পৃষ্ঠতলে একটা দ্বিস্তরের পাতলা থলি, এর প্রদাহ, লাল হওয়া ও ফুলে যাওয়াকে পেরিকার্ডাইটিস Pericarditis বলে। কখনো অতিরিক্ত তরল পদার্থ পেরিকার্ডিয়াল স্তরে জমা হয়, যা পেরিকার্ডিয়াল ইফ্যুসন নামে পরিচিত। পেরিকার্ডিটিস সাধারণত: একটা তীব্র অবস্থা যা হঠাৎ উদয় হয় এবং তিন মাস পরে কমে যায়। পেরিকার্ডিটিস সব বয়সের লোকের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে তবে ১৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সের লোকেরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
হঠাৎ করেই পেরিকার্ডাইটিসের সূত্রপাত ঘটে থাকে তবে রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘস্থায়ী হয় না (অ্যাকিউট)। এই রোগ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকলে এবং স্থায়ী রূপ ধারণ করলে সেটিকে তখন ক্রনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেরিকার্ডাইটিস চিকিৎসা ছাড়া এমনিতেই সেরে যায়। রোগটি তীব্র রূপ নিলে ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় পেরিকার্ডাইটিস নির্ণয় ও সুচিকিৎসা করা হলে সংশ্লিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলির ঝুঁকি কমানো সম্ভব হয়।
পেরিকার্ডাইটিসের এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গ
পেরিকার্ডাইটিসের কারণে বুকে তীব্র ব্যাথা হতে পারে যা কাশির সময়, কিছু গেলার সময় এবং লম্বা শ্বাস নেবার সময় এটা আরো খারাপ আকার নেয়। পেরিকার্ডাইটিসের অন্যান্য উপসর্গগুলি হলো:
- বুকের তীক্ষ্ণ ব্যথা (Sharp chest pain)- হৃদপিন্ডের উপরিভাগে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব এবং কখনো এই ব্যথা বুক হতে বাম হাত পর্যন্ত সম্প্রসারিত।
- বুকে সামন্য চাপ দিলে বেদনায় অস্থির এবং রোগির শ্বাস কষ্ট (Difficulty breathing) হয়।
- নাড়ী স্পন্দন ঠিকমত হয় না। শ্বাস নেবার সময় ব্যথা অনুভব করা (Hurts to breath)
- পেরিকার্ডিয়ামের মধ্যে পানি, রস, রক্ত, পুঁজ সৃষ্টি হয়।
- সুস্থ্য অবস্তায় হৃদপৃন্ড এবং পেরিকার্ডিয়াম পৃথকভাবে থাকে কিন্তু পেরিকার্ডাইটিস রোগে আক্রান্ত হলে হৃদপিন্ড এবং পেরিকার্ডিয়াম জুড়ে যায়।
- শুকনো কাশি। বমি বমি ভাব (Nausea)
- দুশ্চিন্তা হয়।
- পেরিকার্ডিয়ামের মধ্যে রস সঞ্চয় হলে হৃদপিন্ডের গতি ব্যহত হয়, রোগি অস্থির ও উদ্বেগপূর্ণ হয়, এতে ফুসফুসের উপর চাপ পড়ায় শ্বাসকষ্ট হয়।
- ক্লান্তি ভাব আসে।
- মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়। শোথ ভাব, প্রলাপ ও বিবর্ণরূপ হয়।
- পিঠে, গলায় এবং কাঁধে ব্যাথা।
- শোওয়ার সময় শ্বাসকষ্ট (Shortness of breath )।
- পেট ফুলে যাওয়া।
- পায়ে ও পায়ের পাতায় ফোলা।
- অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন (Irregular heart beat)।
- পেরিকার্ডিয়ামে পানি সঞ্চিত হলে হৃদপিন্ডের উপরের দিকে ঘর্ষণ শব্দ শোনা যায়। পানির চাপে হৃদযন্ত্রের শক্তি কমে যায়।
- শরীরের নিম্নাংশে ব্যথা (Lower body pain) হয়।
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (Fainting)
- পেটে তীক্ষ্ণ ব্যথা (Sharp abdominal pain)
পেরিকার্ডাইটিসের এর প্রধান কারণগুলো কি কি?
এর পিছনে কারণগুলো বেশিরভাগ জানা যায় না, কিন্তু এটা সাধারণত নিম্নলিখিত সম্ভাব্য কারণে হয়:
- ব্যাকটিরিয়াল সংক্রমণ, ফাঙ্গাল সংক্রমণ।
- ভাইরাল সংক্রমণ যার জন্য ঠান্ডা লাগে বা নিমুনিয়া হয়।
- ক্যান্সার।
- এইচআইভি সংক্রমণ।
- কিডনি ফেইলিওর।
- টিউবারকুলোসিস।
- হার্ট অ্যাটাক।
- কিছু কিছু ওষুধ যেমন- আইসোনিয়াজিড, ফেনিটয়েইন ও বেশ কিছু ক্যান্সারের ওষুধ।
- লুপাস বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর মতো ইনফ্লামেটরি ডিজিজ (প্রদাহ/জ্বালাপোড়াজনিত রোগ)।
- হৃৎপিণ্ডের নিকট অবস্থিত কোনো টিউমার থেকে সৃষ্ট ক্যানসার।
- বুক, খাদ্যনালী এব হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি করে এমন আঘাত বা সার্জারি।
- রেডিয়েশন থেরাপি।
- ইমিউন সিস্টেমের প্রভাব ফেলে এমন ঔষধ।
- কোন কঠিন রোগে আক্রান্ত যেমন- গেঁটে বাত, এলুমিনুরিয়া, বহুমূত্র ইত্যাদি।
- হৃদ আবরক ঝিল্লিতে রস বা জলীয় পদার্থ সঞ্চিত।
পেরিকার্ডাইটিস Pericarditis কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো পেরিকার্ডিটিস নির্ণয়ের জন্য করা হয়:
- ইমেজিং পরীক্ষা
এর অন্তর্গত পরীক্ষাগুলো হলো বুক ও হার্টের এমআরআই, বুকের এক্স-রে, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ই-সি-জি) (Electrocardiogram, ECG), এবং হার্টের সিটি স্ক্যান। - ল্যাব পরীক্ষা
ট্রোপোনিন-আই (Troponin-I) পরীক্ষা হার্টের পেশীর ক্ষতি দেখবার জন্য, রক্তের কালচার, সি-বি-সি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) (CBC, Complete Blood Count), টিউবারকুলিন ত্বকের পরীক্ষা, এইচআইভি পরীক্ষা, ব্লাড ইউরিয়া নাইট্রোজেন, বি-ইউ-এন (Blood Urea Nitrogen, BUN), অ্যান্টিনিউক্লিয়ার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা, ইলেক্ট্রোলাইটস, সেরাম (Electrolytes, serum), স্পুটাম ফর এ-এফ-বি (Sputum for AFB), ক্রিয়েটিনিন, সেরাম (Creatinine, Serum) ইকো কার্ডিওগ্রাম ২ডি (Echo cardiogram 2D) এবং ই-এস-আর (এরাইথ্রোসাইট সেডিমেন্টেশন রেট) (ESR, Erythrocyte Sedimentation Rate) ।
চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে কি কারণে এই রোগ হয়েছে তার উপর। কারণের উপর নির্ভর করে নিম্নলিখিত চিকিৎসাগুলি করা হয়:
পেরিকার্ডাইটিস Pericarditis এর হোমিওপ্যাথিক ওষুধ
ক্যাকটাসঃ হৃদপিন্ড ও ধমনীর উপর বিশেষ ক্রিয়া। হৃদ আবেষ্টনীর প্রদাহ তৎসহ মাইট্রাল ভালবের স্বাভাবিক ক্রিয়ার বিকৃতি। শ্বাসকষ্ট ও বেদন। দ্রত এবং প্রবল হৃদস্পন্দন। হৃদপিন্ডের শিখর দেশে ব্যথা। মাথা ঘোরে।
কনভেনোরিয়া মেজালিসঃ সারা বুক জুড়ে যেন স্পন্দন। হৃদ আবরনীর প্রদাহ, শুলে বৃদ্ধি মনে হয়। হৃদক্রিয়া বন্ধ পরক্ষণেই চলতে থাকে। পা দু’টি কাপে, কবজি ও গোড়ালিতে কামড়ানি।
ক্যালমিয়া ল্যাটিফোঃ হৃদযন্ত্রের উপর বিশেষ ক্রিয়া। হৃদযন্ত্র দূর্বল, নারী ধীর, বুকে ধরফরানি, উৎকন্ঠা। হৃদস্পন্দন সামনের দিকে ঝুকলে বৃদ্ধি। গেটে বাত, বাত লোপ হয়ে হৃদযন্ত্রে তীব্র ব্যথা।
ভিরেট্রাম ভিরিডিঃ হৃদযন্ত্রের উপর বিশেষ ক্রিয়া, থেকে থেকে হৃদপিন্ডের তন্তুসমূহের কম্পন। হৃদপিন্ডের সংকোচক ও প্রসারক ক্রিয়ার অবনতি। ফুসফুসে ও মস্তিস্কে রক্ত সঞ্চয়, ভয়াবহ বমি, ঝাকি মারা, তড়কা, হৃদপিন্ডের বাত।
এপিস মেলঃ পেরিকার্ডাইটিসের সাথে শোথ, ব্যথা, প্রস্রাবের স্বল্পতা, হৃদপিন্ডে ক্ষতবৎ ব্যথা। হাটু ফোলা, চকচকে ভাব, স্পর্শকাতর। বুকে হুল ফোটানো ব্যথা। পা দুটোতে শোথ ভাব, হাত ও আঙ্গুলের ডগায় অসার ভাব।
- পেরিকার্ডিওসেন্টেসিস
এটা থলি থেকে সুঁচের দ্বারা তরল পদার্থ বার করার পদ্ধতি। - পেরিকার্ডিয়েক্টমি
প্রচন্ড বাড়াবাড়ি ক্ষেত্রে এই অপারেশন করা হয় যেখানে পেরিকার্ডিয়ামের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ বাদ দেওয়া হয়। এটা একমাত্র দীর্ঘকালীন পেরিকার্ডাইটিসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।