স্বরযন্ত্রের প্রদাহ (Laryngitis) কারণ, লক্ষণ ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

সংজ্ঞা (Definition): স্বরনালীর শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর প্রদাহকে স্বরযন্ত্রের প্রদাহ (Laryngitis) বলে। যে কোন কলকা স্বরযন্ত্রের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী স্ফীত হয়ে প্রদাহিত হয় এবং এক প্রকার চটচটে শ্লেষ্মা নিসৃত হয় একেই ল্যারিনজাইটিস বলে।

 

স্বরযন্ত্রের প্রদাহ (Laryngitis) এর কারণ (Causes of Laryngitis):

(i) হিম, ঠাণ্ডা লাগা, জলে ভিজা, চিৎকার করে কথা বলা, উগ্র বায়ু ধূলা গলার মধ্যে প্রবেশ করা, সর্বদাই গলায় গরম কাপড় জড়িয়ে রাখা বা অতিরিক্ত গরম আহার গ্রহণ করা। (ii) হাম, উপদংশ, টাইফাস রোগের উপসর্গ হিসাবে। (iii) জীবানু সংক্রমন, জীবানু সংক্রমনে স্বরযন্ত্রের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী স্ফীত, প্রদাহিত হয়ে এই প্রকার চটচটে শ্লেষ্মা বের হয়। এই জাতীয় জীবানুর মধ্যে ষ্টাঘাইলো এবং নিউমোকক্কাস প্রধান।

 

স্বরযন্ত্রের প্রদাহ (Laryngitis) এর লক্ষণ (Clinical signs and symptoms):

(i) সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, গলা খুসখুস করা, কুট কুট করা। (ii) অনেক সময় কঠিন কাশির লক্ষণ প্রকাশ পায়। (iii) কোন কোন সময় জ্বরের মধ্যে ক্ষুধাহীনতা, গা বমি বমি, ঘন ঘন কাশি, শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। (iv) গলার মধ্যে ঘড় ঘড় শব্দ যুক্ত শ্বাস প্রশ্বাস, কর্কশ স্বর, স্বর লোপ, স্বর ভংগ। (v) শ্বাসকষ্ট, অবসন্নতা, প্রলাপ। (vi) রোগী মনে করে গলার ভিতর কিছু একটা আটকে আছে, কাঁটা বিদ্ধবৎ অনুভব; অনেক সময় ঘুমের পর একদম কথা বলতে পারে না। (vii) সূত্রবৎ দুচ্ছেদা শ্লেষ্মা নিঃসরণ এবং রোগী অস্থির হয়ে পড়ে।

 

স্বরযন্ত্রের প্রদাহ (Laryngitis) এর প্রকার ভেদ (Classification):

ল্যারিনজাইটিস সাধারণত দু প্রকার তরুণ এবং পুরাতন। তরুন ল্যারিনজাইটিস আবার লক্ষনানুসারে বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন-

i) একিউট ক্যাটারাল (ii) সাবমিউকাস (iii) ইডিমেটাস, (iv) সিফিলিটিক (v) টিউবার কিউলাস

 

স্বরযন্ত্রের প্রদাহ (Laryngitis) এর রোগ নির্ণয় পদ্ধতি (Diagnosis):

(i) অনেক অভিজাত চিকিৎসক কাশির চরিত্র এবং গলার স্বর পরিবর্তন-শুধু এই দুটো বিচার করে ব্যাধি নির্ণয় করে ঔষধ নির্বাচন করেন।

(ii) দর্পনের সাহায্যে মুখ করে এই রোগের অনেক লক্ষণ বুঝতে পারা যায়।

(iii) ব্যাকট্রয়াল বা প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষার দ্বারা অথাৎ থুথু, গয়ের পরীক্ষা করালে সহজেই রোগ ধরা পড়ে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে লক্ষণ বিবেচনার চেয়ে যান্ত্রিক উপায়ে রোগ নির্ণয়ের গুরুত্ব অনেক বেশী বলে বিবেচিত। কিন্তু যান্ত্রিক উপায় অত্যধুনিক পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা গরীব বা নিম্নবৃত্ত রোগীদের পক্ষে একটি নিষ্ঠুর পরিহাস। কারণ এই ক্ষেত্রে যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন তা সংগ্রহ করা তাদের পথে সম্ভব নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি অবশ্যই হয়েছে কিন্তু সেটা ধনীদের মধ্যেই সীমিত।

 

স্বরযন্ত্রের প্রদাহ (Laryngitis) এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:- (Homoeopathic Treatment)

হিপার সালফার : গলাধরা, গলার স্বর কর্কশ, ক্রুপের মত কাশি, কুকুরের ডাকের মত কাশি। সামান্য ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না। শ্বাসকষ্ট গলার সর্দি ঘড় ঘড় করে কিন্তু কাশলে কিছুই উঠে না। কোন বিছু গেলার সময় গলার বেদনা কান পর্যন্ত বিস্তৃত। এক মাত্রা করে দিনে ৪/৫ বার।

ক্যালকেরিয়া আয়োড  : গলনালীতে যন্ত্রণা ও টাটানিবোধ, জ্বালাপোড়া। ল্যারিনসের বেদনা, অনবরত কাশি; গলা ধরা। কুকুরের আওয়াজের মত কাশির শব্দ। কোন কিছু গিলতে কষ্ট হয়। গলায় ব্যথা লাগে। প্রয়োগবিধি (Application)- ৩/৪ গ্রেন Distilled water এ মিশ্রিত করে একচামচ করে আধ ঘঃ অন্তর

আর্সেনিক এন্বাম : ল্যারিনসের ভয়ানক জ্বালা যন্ত্রনা, খাদ্য গ্রহণ ও পানীয় গ্রহণে বেদনা বোধ। মনে হয় জিহ্বার গোড়ায় একটা চাপ আছে। শুষ্ক কাশি, ঘন ঘন কাশি। দিনে বেশী। রাত্রে বিছানার গরমে কম। প্রয়োগবিধি (Application)- এক মাত্রা করে দিনে ৪/৫ বার।

ব্রোমিয়াম : ল্যারিংস এবং ট্রেকিয়ার প্রদাহ। ল্যারিংসে সর্দি জমে থাকে।

আয়োডাম : ল্যারিংসের প্রদাহ, শুদ্ধ কাশি, গলা কুটকুট করে ও জ্বালাপোড়াভাব। সাবানের ফেনার মত গয়ার। ল্যারিংস ফোলা। সারা বছর সর্দিতে ভোগে। শ্বাসনালীর সংকোচন। গল গ্রন্থি বৃদ্ধি। প্রয়োগবিধি (Application)- এক মাত্রা করে দিনে ৫/৬ বার।

 

অন্যান্য প্রয়োজনীয় ঔষধ (Other important remedies): একোনাইট ন্যাপ 3x, কষ্টিকাম 6/30 এলিয়াম সেপা 6/30, এলিয়াম সেপা 6/30, এপিস মেল 30, ষ্ট্যানাম 6/30, ল্যাকোসিস 6/30, ওসেরা 30, আজেন্ট মেট 3x, বিচূর্ণ ফেরাম পিকক্রিক 200, এসিড নাই 6/30, সেলিনিয়াস 3x, স্যাংগুনেরিয়া 1x,

 

বায়োকেমিক ঔষধ (Bio Chemic medicines):

ফেরাম ফস 6x, ন্যাট্রাম মিউর 6x, 12%, ক্যালিমিউর 6%, 12%, বিশেষ উপকারী। ২/৩ গ্রেণ মাত্রায় সামান্য উষ্ণ গরম জলে দিনে ৪/৫ বার সেব্য।

 

জটিল উপসর্গ (Complications):

বেশীদিন ভুগলে স্ট্রেকিয়া, ব্রংকাই, ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারে। ইহার ফলে ব্রংকাইটিস। নিউমোনিয়া হবার সম্ভাবনা। কোন কোন ক্ষেত্রে গ্লটিস, ইপিগ্লটিস আক্রান্ত হতে পারে। পুরিশি বা যগ্নস্নাও হতে পারে।

 

পথ্য ও আনুষংগিক ব্যবস্থা (Diet and management):

পূর্ণবিশ্রাম প্রয়োজন। রোগী যে ঘরে থাকার সেই ঘরটি সর্বদাই গরম রাখা এবং ঘরের মধ্যে যাতে ধূলোবালি প্রবেশ না করে সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ইরিটেশান এবং প্রদাহের হ্রাস করার জন্য গলার ভিতর ঔষধ স্প্রে নামক যন্ত্রের সাহায্যে ব্যবহার করা যায়। ফুট বাথ অর্থাৎ গরম জলে দুটি পা কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখলে উপকার। সাবু বার্লি দুধ, হরলিক্স প্রভৃতি পানীয় পথ্য গরম। করে দেয়া যায়। স্নানের পরিবর্তে গরম জলে স্পজিং করলে ভাল হয়। স্পঞ্জিং করার পর গরম কাপড় দিয়ে রোগীর শরীর আবার ঢেকে রাখা। ঘাস হলে উপকার। সময় মত পথ্য এবং হজম করতে পারে এমন উষ্ণ তরল পুষ্টিকর আহার প্রয়োজন।

Related posts

Leave a Comment